স্থপতি থেকে সফল উদ্যোক্তা: জান্নাতুল ফেরদৌসের ‘ভূমি আর্টিজান’-এর গল্প
করোনাকালে ঘরবন্দী সময় থেকেই শুরু। ফেসবুকে ‘গৃহকাব্য’ নামের একটি পেজে নিজের ঘর সাজানোর ছবি দিতেন জান্নাতুল ফেরদৌস। একদিন সেখানে পোস্ট করলেন নিজের নকশায় তৈরি কয়েকটি পট প্ল্যান্টের ছবি। এরপরই বদলে যায় গল্পের ধারা—মুহূর্তেই ইনবক্স ভরে যায় ক্রেতাদের প্রশ্নে, “দাম কত?”
উত্তরে জানাতে হয়—এসব পণ্য আসলে নিজের ঘর সাজানোর জন্য বানানো। কিন্তু আগ্রহ থামেনি। বরং সেখান থেকেই আসে প্রথম অর্ডার, আর জন্ম হয় নতুন এক ব্র্যান্ডের—‘ভূমি আর্টিজান’।
এক নামেই পরিচিতি পেল ‘ভূমি’
নামের গল্পটিও চমৎকার। জান্নাতুলের ভাষায়, “এক বড় আপু বাংলা খুব ভালো জানতেন। তাঁর কাছেই নাম চাইলে ‘ভূমি’ প্রস্তাব করেন। কারিগরদের সম্মান জানিয়ে সঙ্গে যোগ করি ‘আর্টিজান’।”
ছোট্ট একটি লিভিংরুম থেকে শুরু হওয়া এই উদ্যোগ এখন নারায়ণগঞ্জে তিনটি ওয়্যারহাউসে দাঁড়িয়ে। পাঁচজন স্থায়ী কর্মী এবং মোট ৩৪ জন কারিগরের সমন্বয়ে চলছে ‘ভূমি আর্টিজান’-এর উৎপাদন।
মাটি, বাঁশ ও বেতের পণ্যে আন্তর্জাতিক নকশার ছোঁয়া—এটাই ব্র্যান্ডটিকে করেছে আলাদা। হালকা ওজন, টেকসই এবং নান্দনিক ডিজাইনের কারণে ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে ব্র্যান্ডটি।
স্থপতি থেকে উদ্যোক্তা হওয়ার পথ
স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে স্থাপত্যবিদ্যা পড়েছেন জান্নাতুল ফেরদৌস। তবে তাঁর টান ছিল সবসময় দেশীয় হস্তশিল্পে। ক্লাস শেষে বন্ধুরা যখন আড্ডায় ব্যস্ত, তখন তিনি ঘুরে বেড়াতেন আড়ং, যাত্রা, অরণ্যসহ দেশীয় কারুশিল্পের দোকানগুলোতে।
তৃতীয় বর্ষে বিয়ে, থিসিসের সময় মাতৃত্ব—এরপরই শুরু মহামারি। সন্তানকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে মায়ের বাড়িতে থাকা অবস্থায় ফেসবুকে পাওয়া প্রতিক্রিয়া তাঁকে আরও সাহসী করে তুলল। নিয়মিত বিক্রির পোস্ট দিতে থাকলেন।
তবে সমাজের চাপ থামেনি। “অনেকে বলত, স্থাপত্য পড়িয়ে লাভ কী হলো—মাটির পণ্য বিক্রি করি!”—বললেন জান্নাতুল। পরিবারের চাপে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও থামেননি।
একসময় ধানমন্ডির একটি আর্কিটেক্ট ফার্মে কনসালট্যান্ট হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। দেড় বছর কাজের পর বুঝলেন—নারায়ণগঞ্জ থেকে নিয়মিত ঢাকায় যাতায়াত, সন্তান দেখাশোনা আর অফিস—সবকিছু সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
শেষমেশ চাকরি ছেড়ে সম্পূর্ণ মনোযোগ দেন ‘ভূমি আর্টিজান’-এ। চাকরির সমস্ত সঞ্চয়ও বিনিয়োগ করেন নিজের স্বপ্নে।
ঈদ-বৈশাখে ঝড়ের চাহিদা
জান্নাতুল জানালেন, ঈদ, পূজা, বৈশাখে তাঁদের পণ্যের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সাধারণ সময়েও প্রতি মাসে লাখ টাকার বেশি বিক্রি হয়। শুধু দেশেই নয়, অনেক ক্রেতা বিদেশে উপহার পাঠানোর জন্যও কিনে থাকেন ভূমির কারুশিল্প।
মায়ের প্রাথমিক হতাশা আজ গর্বে রূপ নিয়েছে। পাশে পেয়েছেন স্বামী সোহাগ হাসানকেও।
অনলাইনভিত্তিক ব্র্যান্ড, এখন দেশের বাইরে যাত্রার প্রস্তুতি
নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ি এলাকা থেকে পরিচালিত পুরো উদ্যোগটি। তবে ঢাকার ধানমন্ডির ফ্রেন্ডশিপ ‘কালার অব দ্য চর’ দোকানেও এখন ভূমি আর্টিজানের নির্দিষ্ট কিছু পণ্য পাওয়া যায়। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক বাজারেও আরও বড় পরিসরে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে জান্নাতুলের।
ব্যক্তিগত এক ঘর সাজানোর নেশা থেকে সৃষ্টি। আর সেই থেকেই সফল উদ্যোক্তা হয়ে ওঠা—জান্নাতুল ফেরদৌসের গল্প আজ অনেকেরই অনুপ্রেরণা।
Comment / Reply From
You May Also Like
Popular Posts
Newsletter
Subscribe to our mailing list to get the new updates!