Dark Mode
Image
  • Tuesday, 16 December 2025

খাগড়াছড়ির পাঙ্খোয়াদের গ্রাম: পাহাড়ি জুমচাষিদের রঙিন বাজারে এক বিকেলের অভিজ্ঞতা

খাগড়াছড়ির পাঙ্খোয়াদের গ্রাম: পাহাড়ি জুমচাষিদের রঙিন বাজারে এক বিকেলের অভিজ্ঞতা

খাগড়াছড়ির পাঙ্খোয়াদের গ্রামে গেলে চোখে পড়বে এক অনন্য দৃশ্য—পাহাড়ি জুমচাষিদের ছোট্ট বাজার। প্রচলিত বাজারের মতো নির্দিষ্ট কোনো স্থাপনা নয়; গাড়ি চলাচলের সরু রাস্তার দুই পাশে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই জমে ওঠে এ বাজার। যদিও আনুষ্ঠানিক হাট বসে সোমবার ও বৃহস্পতিবার, তবু প্রতিদিনই এখানে লেগে থাকে কেনাবেচার চাঞ্চল্য।

নারীদের হাতে পাহাড়ের ফসল

এই বাজারের বেশির ভাগ বিক্রেতাই পাহাড়ি নারী। ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত, পিঠে বাঁশ–বেতের ঝুড়ি নিয়ে তাঁরা হাজির হন নিজেদের জুমের খেতের ফসল নিয়ে।
তেমনই একজন সুখি রানী—বাবার বাড়ি পানছড়ি, শ্বশুরবাড়ি নয় মাইল। নিজের চাষের ফসল বিক্রি শেষে আবার সেই টাকায় পরিবারের প্রয়োজনীয় নিত্যসামগ্রী কিনে নেন।

জুমের ফলন—স্বাদে-গন্ধে আলাদা

এই বাজারে চোখে পড়বে পাহাড়ি সবজির বিশাল সংগ্রহ।
মারফা, বাঁশ কোরল, পাহাড়ি কলা, জলপাই, কচু ও কচুর ছরা, কাঁকরোল, মাশরুম, তেঁতুল, বরবটি, মরিচ, পেঁপে, লাউশাক—সব মিলিয়ে এক পাহাড়ি সমৃদ্ধির গল্প।
ঝুড়িতে পলি, কলাপাতা বা ত্রিপল বিছিয়ে রাখা শাকসবজির দামও বেশ সাশ্রয়ী—১০ থেকে ৫০ টাকার মধ্যেই বেশি ভাগ সবজি কেনা যায়।

কেটেকুটে রান্নার উপযোগী করে আনা বাঁশ কোরলও পাওয়া যায় মাত্র ৩০ টাকায় প্রতি কেজি।

ক্রেতাদের ভরসার জায়গা

স্থানীয় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বাঙালি চাকরিজীবী, ছাত্রছাত্রী কিংবা পর্যটক—সবাইই এই বাজারে নিয়মিত ক্রেতা।
তাঁদের আকর্ষণ, জুমে চাষ করা রাসায়নিকমুক্ত টাটকা সবজি।

সৌদি প্রবাসী জামাল উদ্দিনও এমন একজন ক্রেতা। ছেলে খাগড়াছড়ির ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ে—তার জন্যই এখানে থাকা। প্রতিদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে বাজারে এসে কিনে নেন লাউ, মরিচ, বরবটি, পেঁপে—যা মিলবে সেদিন।

বাজারের আলো-আঁধারে পাহাড়ি গল্প

বিকেল নামতেই বাজার ডুবে যায় আলো-আঁধারে। স্থায়ী দোকানগুলোর আলোয় তখনও জমজমাট লেনদেন। মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ চলে যায়—তবু বাজার থেমে থাকে না; যারা আলো পায় তাদের দোকানের সামনে গিয়ে বসে বাকি বিক্রেতারা।

এই অন্ধকার-আলোয় দাঁড়িয়ে একজন বিক্রেতা বোঝাচ্ছিলেন মারফা সম্পর্কে। প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল চিন্দ্রা বাঙ্গি! পরে জানালেন—এটা শসা জাতীয় সবজি। কাঁচা সালাদ হিসেবেও খাওয়া যায়, আবার পাকলে রান্না করা যায়। ক্রেতারা তাঁর বর্ণনা শুনে কৌতূহলেই কিনে নিলেন কয়েক কেজি।

একজন ভুট্টা কিনতে আসলে বিক্রেতা নিজেই খোসা ছাড়িয়ে দেখে নিলেন ভেতরের দানা ঠিক আছে কিনা—তারপর ওজন।

জুমচাষের কষ্টের কথা

কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এলো জুমচাষের কঠিন বাস্তব। বর্ষার আগে পাহাড়ের ঢালে ঝোপঝাড় পুড়িয়ে তৈরি করতে হয় জমি। তারপর কুপিয়ে বীজ বপণ, সেচ দেওয়া—সবটাই নির্ভর করে আবহাওয়ার ওপর। সময়মতো বৃষ্টি না হলে শ্রম আরও বেড়ে যায়। এখন অনেকের মোটরচালিত পাম্প থাকায় কিছুটা স্বস্তি মিলেছে।

মজার মিল—বিক্রেতার নামও ‘মারফা’

বাজার থেকে বেরোনোর আগে আমিও একটি মারফা কিনলাম—দাম মাত্র ১০ টাকা। আর মজার ব্যাপার হলো—যাঁর কাছ থেকে কিনলাম, তাঁর নামও মারফা! মারফা ত্রিপুরা।
কথা বলতে বলতে যখন নম্বর চাই, তখন নির্লিপ্ত উত্তর—
“ফোন কেনার মতো টাকা নাই। এভাবেই বেশ আছি।”

সেই সরলতা যেন পাহাড়ের মতোই শান্ত।

শেষ কথা

খাগড়াছড়িতে গেলে এই জুমচাষিদের ছোট্ট, রঙিন, জীবন্ত বাজারটি অবশ্যই ঘুরে দেখার মতো।
এখানে শুধু সবজি নয়—পাহাড়ি জীবনের সরলতা, পরিশ্রম, বন্ধুত্ব আর গল্প—সবই মিলেমিশে এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা তৈরি করে।

খাগড়াছড়ির পাঙ্খোয়াদের গ্রাম: পাহাড়ি জুমচাষিদের রঙিন বাজারে এক বিকেলের অভিজ্ঞতা

Comment / Reply From